গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এই মেট্রোপলিটন এলাকা আয়তনের দিক থেকে দেশের সর্ববৃহৎ মহানগর পুলিশ এলাকা হিসেবে স্বীকৃত। প্রায় ৩৩০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত জিএমপি’র অধীনে রয়েছে প্রায় ৬৫ লক্ষ নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জনগণের জান-মাল, শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এই বাহিনী “গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স, ২০১৮” অনুযায়ী পরিচালিত হয়।
গাজীপুর মহানগরীর আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জিএমপি’র অধীনে মোট ৮টি থানা রয়েছে। এগুলো হলো: গাজীপুর সদর, বাসন, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, গাছা, পূবাইল, টঙ্গী পূর্ব ও টঙ্গী পশ্চিম থানা। কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য জিএমপি-তে কয়েকটি প্রধান বিভাগ রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হেডকোয়ার্টার্স ডিভিশন, অপরাধ উত্তর ও অপরাধ দক্ষিণ বিভাগ, অপারেশনস ডিভিশন, সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ (সিটিএসবি), ট্রাফিক বিভাগ, মহানগর গোয়েন্দা উত্তর ও দক্ষিণ বিভাগ। গাজীপুর মহানগর পুলিশের অপরাধ বিভাগকে দুইটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে- অপরাধ উত্তর বিভাগ ও অপরাধ দক্ষিণ বিভাগ। অপরাধ-উত্তর বিভাগের অধীনে রয়েছে সদর ও কোনাবাড়ী নামে দুটি জোন। সদর জোনের আওতায় রয়েছে গাজীপুর সদর ও বাসন থানা এবং কোনাবাড়ী জোনের আওতায় রয়েছে কোনাবাড়ী ও কাশিমপুর থানা। অপরদিকে, অপরাধ দক্ষিণ বিভাগের অধীনে রয়েছে টঙ্গী ও গাছা নামে দুটি জোন। গাছা জোনের অন্তর্ভুক্ত থানাগুলো হলো গাছা ও পূবাইল এবং টঙ্গী জোনে টঙ্গী পূর্ব এবং টঙ্গী পশ্চিম থানা। এই কাঠামো জিএমপির কার্যক্রমকে আরও কার্যকর, এবং জনবান্ধব করে গড়ে তুলতে সহায়তা করছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন বিভাগ বিভিন্ন স্তরে কাজ করে যাচ্ছে। অপরাধ ও অপারেশনস বিভাগ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধের তদন্ত ও গ্রেফতারি পরোয়ানা বাস্তবায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) অপরাধীদের শনাক্তকরণ, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারসহ চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদঘাটনে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ট্রাফিক বিভাগ নগরীর যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সড়ক নিরাপত্তায় জনসচেতনতা তৈরিতে কাজ করে। সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ (সিটিএসবি) দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পাসপোর্ট যাচাই, ভিআইপি/ভিভিআইপি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এসব বিভাগের সমন্বিত প্রচেষ্টায় গাজীপুর মহানগরী একটি নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে উঠছে।
গাজীপুর মহানগর এলাকা দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা সংবেদনশীল অঞ্চল। এই এলাকায় কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারসহ মোট পাঁচটি কারাগার এবং ছয়টি শিশু উন্নয়ন ও আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ এলাকার আওতাধীন ২১টি প্রতিষ্ঠান কেপিআই (Key Point Installation) অন্তর্ভুক্ত, যা জাতীয় নিরাপত্তা ও গুরুত্ব বিবেচনায় বিশেষ মর্যাদা রাখে। এ অঞ্চলে রয়েছে একটি সমরাস্ত্র কারখানা, বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন (টাকশাল), গাজীপুর স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, টেলিযোগাযোগ স্টাফ কলেজ, এবং কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র। এছাড়া কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার, জেলা কারাগার, টেলিফোন শিল্প সংস্থা, দুটি রেলওয়ে স্টেশন, একটি রেলওয়ে জংশন, সরকারি হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজও রয়েছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ছোট-বড় ১০-১২টি বাস স্টেশন এবং সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের আঞ্চলিক অফিসসহ অসংখ্য ব্যাংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। গাজীপুর মহানগর শিক্ষার দিক থেকেও সমৃদ্ধ। এখানে রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইইউটি), ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ, প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, একটি সরকারি মহিলা কলেজ, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কলেজ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসা।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের আওতাভুক্ত এলাকায় রয়েছে মোট ৬২.৪৫ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ২৮ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক যা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার অংশ। উল্লেখযোগ্য জাতীয় মহাসড়কগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ২৫ কিলোমিটার অংশ, ঢাকা বাইপাস মহাসড়কের ১৪ কিলোমিটার, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ১০.৫ কিলোমিটার এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ৫ কিলোমিটার। এসব মহাসড়কের উপর দিয়ে দেশের ৩৬টি জেলার যানবাহন নিয়মিত চলাচল করে, যা এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে করে তুলেছে অত্যন্ত ব্যস্ততম। গাজীপুর মেট্রোপলিটন ট্রাফিক বিভাগের অন্তর্গত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আব্দুল্লাহপুর ব্রিজ হতে রাজেন্দ্রপুর পর্যন্ত অংশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচল করে। এই ব্যাপক যানবাহন চলাচল গাজীপুরকে দেশের অন্যতম প্রধান ট্রান্সপোর্ট রুটে পরিণত করেছে।
মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় জমায়েত “বিশ্ব ইজতেমা” প্রতি বছর এই মহানগরের টঙ্গী এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে দেশ-বিদেশ থেকে আগত লাখ লাখ মুসল্লির সমাগম ঘটে। পাশাপাশি, গাজীপুর মহানগরে রয়েছে প্রায় ৩,৫০০ গার্মেন্টস ও শিল্প প্রতিষ্ঠান, যেখানে ২০ লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মরত আছেন। এ বিশাল শ্রমশক্তির একটি বড় অংশই অস্থায়ীভাবে মহানগর এলাকায় বসবাস করেন, যার ফলে গাজীপুর একটি ঘনবসতিপূর্ণ ও কর্মচাঞ্চল্যপূর্ণ নগরীতে পরিণত হয়েছে।
গাজীপুর মহানগরীতে রয়েছে একাধিক আধুনিক ও অভিজাত রিসোর্ট, যেখানে প্রতিনিয়ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশি অতিথি আগমন ও প্রস্থান করেন। এ সকল রিসোর্টে তাদের নিরাপত্তা সর্বদা সতর্কতার সাথে বিবেচনা করা হয়।। পাশাপাশি, গাজীপুর মহানগরীতে রয়েছে অসংখ্য পিকনিক স্পট ও শুটিং স্পট, যা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ভ্রমণপিপাসুদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ছুটির দিন কিংবা উৎসবের মৌসুমে পরিবার-পরিজনসহ হাজারো মানুষ এই অঞ্চল ঘিরে গড়ে ওঠা রিসোর্ট ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণে আসেন।
গাজীপুর মহানগরীর শান্তি, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে চলেছে। প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষের জীবনযাত্রা, যানবাহন চলাচল ও সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই বাহিনী নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। জিএমপির প্রতিটি সদস্য পেশাদারিত্বের সাথে গাজীপুরকে একটি নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও নাগরিকবান্ধব নগরীতে রূপান্তরে অঙ্গীকারবদ্ধ। গাজীপুর মহানগরসহ দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় জিএমপি একটি সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।